Monday 10 August 2015

ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় সিরাজ, আকরাম

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা ও লুণ্ঠনসহ মোট সাতটি অভিযোগ রয়েছে এই দুই আসামির বিরুদ্ধে।
রমনা পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার (পেট্রোল) এসএম ইমানুল হক জানান, সিরাজ ও আকরামকে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টার পর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে করে ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হয়।
সকাল ৯টার কিছুক্ষণ আগে ট্রাইব্যুনালে পৌঁছানোর পর যুদ্ধাপরাধ মামলার এই দুই আসামিকে রাখা হয়েছে হাজতখানায়।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সকাল ১০টার পর এ মামলার রায় ঘোষণা করবে।
২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরুর পর এটি হবে একবিংশ রায়।
দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে আদালত গত ২৩ জুন মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রেখেছিল। এরপর গত সপ্তাহে আদালত রায়ের জন্য ১১ অগাস্ট দিন ঠিক করে দেয়।
সিরাজুল হক ও খান আকরাম হোসেনের সঙ্গে আব্দুল লতিফ তালুকদার (৭৫) নামে একাত্তরের আরেক রাজাকার সদস্যের বিচার চলে এ মামলায়। কিন্তু রায়ের আগেই গত ২৭ জুলাই বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় তার মৃত্যু হওয়ায়গত ৫ অগাস্ট আদালত মামলা থেকে তার নাম বাদ দেয়।
গত বছর ৫ নভেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এই তিন আসামির যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল।
সাত অভিযোগের মধ্যে ছয়টিতে সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারকে আসামি করা হয়। একটি অভিযোগে আসামি কেবল আকরাম ও লতিফ। আর দুটি অভিযোগে তিনজনকেই একসঙ্গে আসামি করা হয়।  
২ ডিসেম্বর প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর পর চলতি বছর ২৪ মার্চ পর্যন্ত এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনসহ মোট ৩২ জন সাক্ষ্য দেন।
এরপর গত ৬, ৭ ও ২১ এপ্রিল আসামিদের পক্ষে পাঁচজন সাফাই সাক্ষ্য দেন। এরা হলেন- মো. আমজাদ শেখ, সরদার আব্দুল মান্নান, আব্দুর রশিদ মল্লিক, ইউসুফ আলী দিহিদার ও মো. ফেরদৌস খান।
এরপর ১৫ জুন প্রসিকিউটর সৈয়দ সাইয়্যেদুল হক সুমন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন। আসামি লতিফ তালুকদার অসুস্থ হয়ে পড়লে যুক্তিতর্ক স্থগিত করে আদালত। পরে ১৭ জুন সুমন যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেন।
আসামি আব্দুল লতিফ তালুকদার ও আকরাম হোসেন খানের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম সারওয়ার হোসেন যুক্তি উপস্থাপন করেন ১৮ জুন।
২১ জুন যুক্তি উপস্থাপন করেন সিরাজ মাস্টারের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আবুল হাসান। এই আসামি আর্থিক অসঙ্গতির কথা বলায় আদালত তার মামলা লড়তে আইনজীবী নিয়োগ দেয়।
দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে বিচারিক কার্যক্রম শেষ হওয়ায় মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাগেরহাটের কচুয়ার শাঁখারীকাঠি বাজারে ৪২ জনকে গণহত্যা, ধর্ষণ ও বাড়িতে অগ্নিসংযোগসহ ছয়টি অভিযোগে ২০০৯ সালে সিরাজ মাস্টারসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়।
ওই গণহত্যায় নিহত রঘুদত্তকাঠি গ্রামের শহীদ জিতেন্দ্র নাথ দাসের ছেলে নিমাই চন্দ্র দাস কচুয়া থানায় মামলাটি দায়ের করেন। মামলাটি পরে ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।
ট্রাইব্যুনাল গত ১০ জুন এই তিনজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে কচুয়া থানা পুলিশ পরদিন লতিফ তালুকদারকে গ্রেপ্তার করে। এরপর ১৯ জুন আকরাম হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয় রাজশাহী থেকে। ২০ জুলাই গ্রেপ্তার হন সিরাজ মাস্টার।
প্রসিকিউশনের তদন্ত সংস্থা বলছে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আসামিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করতে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়।
খুলনার আনসার ক্যাম্পে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্র ও গুলি সংগ্রহ করে তারা অন্যান্য রাজাকার সদস্যদের সঙ্গে বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন স্থানে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ চালায় বলে তদন্ত সংস্থার অভিযোগ।
সাত অভিযোগ
অভিযোগ ১:  ১৯৭১ সালের ১৩ মে দুপুর ২টার দিকে রাজাকার বাহিনীর বাগেরহাট সাব ডিভিশনের তৎকালীন ডেপুটি কমান্ডার শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার ও রজব আলী ফকিরের নেতৃত্বে ৫০-৬০ জন রাজাকার এবং বেশ কিছু স্বাধীনতাবিরোধী বাগেরহাট জেলার রঞ্জিতপুর গ্রামে ঘিরে ফেলে। তারা বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাট চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়।
ওই সময় সিরাজুল হক এবং তার সহযোগীরা প্রায় ৪০-৫০ জন হিন্দুকে হত্যা করে। এ ঘটনায় সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, লুটপাট ও অগ্রিসংযোগসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।
অভিযোগ ২:  স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে বাগেরহাট জেলার রামপাল থানার ডাকরার কালী মন্দিরে ভারতের শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার জন্য জড়ো হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের দুই-তিন হাজার লোক। এ খবর পেয়ে তাদের হত্যার জন্য সিরাজ মাস্টার ও রজব আলী ফকিরের নেতৃত্বে ৪০-৫০জন সশস্ত্র রাজাকার ডাকরা গ্রামে যায় এবং নির্বিচারে গুলি চালায়।
এরপর কালী মন্দিরে গিয়ে সেখানে জড়ো হওয়ার মানুষদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ছয় থেকে সাতশ জনকে হত্যা করে তারা। ১৯৭১ সালের ২১ মে বেলা ৩টা থেকে ৫টার মধ্যে এ ঘটনা ঘটে।
সে সময় সিরাজ মাস্টার ও সহযোগীরা ওই এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাট চালায় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনায় সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, লুটপাট ও অগ্নি সংযোগের অভিযোগ আনা হয়।
অভিযোগ ৩: একাত্তরের ১৮ জুন সকাল ১০টার দিকে সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে ২০-২৫ জন পাকিস্তানি সেনা সদস্য এবং ৩০-৩৫ জন সশস্ত্র রাজাকার বেসরগাতী, কান্দাপাড়া গ্রাম এবং কান্দাপাড়া বাজার থেকে ২০ জনকে অপহরণ করে।
তাদেরকে কান্দাপাড়া বাজারে আটকে রেখে নির্যাতন করে সিরাজ মাস্টার ও তার সহযোগীরা। তাদের নির্যাতনে ১৯ জন নিহত হন। অপহৃত শেখ সুলতান আলী ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান, যিনি পরে ১৯৮৪ সালে মারা যান।
এ ঘটনায় সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে খুন, অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।
অভিযোগ ৪: একাত্তরের ১৪ অক্টোবর সকাল ১০টার দিকে সিরাজ মাস্টার ও রজব আলী ফকিরের নেতৃত্বে ১০০-১৫০ জন সশস্ত্র রাজাকার সদর থানার চূলকাঠি গ্রাম, চুলকাঠি বাজার, গণশেমপুর ও আশপাশের এলাকায় হামলা করে এবং প্রায় ৪২টি বাড়িতে লুটপাট চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এরপর সিরাজ মাস্টার ও তার সহযোগীরা ওইসব এলাকা থেকে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ করে তাদেরকে চুলকাঠি বাজারে আটকে রাখে। পরে তাদের নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায় সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতনসহ অন্যান্য অমানবিক কাজের অভিযোগ আনা হয়।
অভিযোগ ৫: মুক্তিযুদ্ধের সময় ৫ নভেম্বর দুপুর ৩টার দিকে সিরাজ মাস্টার, স্থানীয় রাজাকার নেতা খান আকরাম হোসেন ও আবদুল লতিফ তালকদারসহ ৫০-৬০জন রাজাকার সদস্য মিলে কচুয়া থানার শাঁখারিকাঠি হাটে হামলা চালায়।
সেখানে তারা ৪০ জন হিন্দু এবং দুই স্বাধীনতা সমর্থককে আটক করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করে।
এ ঘটনায় তিনজনের বিরুদ্ধে অপহরণ, হত্যাসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।
অভিযোগ ৬: একাত্তরের ২২ অক্টোবর সকাল ১০টা থেকে বিকাল আনুমানিক ৫টা মধ্যে সিরাজ মাস্টার, স্থানীয় রাজাকার নেতা খান আকরাম হোসেন ও আবদুল লতিফ তালুকদার পরিকল্পনা করে স্বাধীনতার পক্ষের লোক হিসেবে পরিচিত টেংরাখালী গ্রামের সতিশ চন্দ্র মণ্ডল, কচুয়া গ্রামের বাবু খান, হাজরাখালী গ্রামের নজরুল ইসলাম শেখ, বারুইখালী গ্রামের মনিন্দ্রনাথ সাহা, চর-টেংরাখালী গ্রামের হাশেম আলী শেখকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে কচুয়া সদরের রাজাকার ক্যাম্পে আটকে রাখে।
এরপর সিরাজ মাস্টার তাদের হত্যার নির্দেশ দিলে থানা পরিষদের পাশে নদীর উত্তরপাড়ে নিয়ে গুলি করে তাদের হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
এ ঘটনায় তিনজনের বিরুদ্ধে অপহরণ, হত্যাসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়।
অভিযোগ ৭: মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা আনুমানিক ৬টার দিকে মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান শিকদার অন্য চার মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে ভাটখলি ক্যাম্প থেকে বাড়ির দিকে যাওয়ার সময় মোড়েলগঞ্জ থানার তেলিগাতীতে খান আকরাম হোসেন ও আবদুল লতিফ তালুকদারসহ রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের হাতে আটক হন।
তারা মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমানের ওপর নির্যাতন চালায় এবং নদীর কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
এ ঘটনায় খান আকরাম হোসেন ও আব্দুল লতিফ তালুকদারের বিরুদ্ধে অপহরণ ও খুনের অভিযোগ আনা হয়।

Share this

0 Comment to "ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় সিরাজ, আকরাম"

Post a Comment