Monday 10 August 2015

তৈরি হচ্ছে আগামীর সৌম্য-মুস্তাফিজরা


সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের বিশাল মাঠটায় গতকাল যখন পা রাখা হলো, ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল পাঁচটা শ্রাবণের মেঘের দাপটে দিনের আলো হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম তবে মাঠটা দীপ্তিময় করে রেখেছে শতাধিক খুদে ক্রিকেটার সবার চোখে ঝিকমিক করছে একটা স্বপ্ন সৌম্য-মুস্তাফিজ হতে চায় ওরা
মাঠের এক প্রান্তে অনেকগুলো সাইকেল। খুদে খুদে ক্রিকেটাররা নানা জায়গা থেকে এসেছে অনুশীলন করতে। এরই মধ্যে একজন সাতক্ষীরা বয়েজ স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী কুশল গাইন। তার স্বপ্ন সৌম্য সরকারের মতো অলরাউন্ডার হওয়া। কেন সাকিব আল হাসান বা বিশ্বের অন্যান্য ডাকসাইটে অলরাউন্ডার নয়? প্রশ্নটা শুনে লাজুক স্বরে কুশলের জবাব, ‘সৌম্য দার ব্যাটিং অন্যরকম। খুব ভালো লাগে। তাঁর মতোই ব্যাট বল করতে চাই।খুদে পেসার আতিক জানাল, মুস্তাফিজের সঙ্গে দেখা করে কাটার মারার কিছু পরামর্শ নিতে চায়। দেখা যে কবে হবে, তা নিয়ে বেশ চিন্তিত! 
অদূরে শিষ্যদের নিয়ে ব্যস্ত মুফাচ্ছিনুল ইসলাম। তিনি সৌম্য-মুস্তাফিজেরও গুরু। শুরুর দিনগুলোয় মুফাচ্ছিনুলের দীক্ষা নিয়েছেন দুজনই। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাতক্ষীরা জেলা ক্রিকেটের কোচ জানালেন, গত এক বছরে, বিশেষ করে সৌম্য-মুস্তাফিজ জাতীয় দলের আলো ছড়ানোর পর রীতিমতো বিপ্লবই ঘটে গেছে জেলা ক্রিকেটে। ছাত্রদের অনুশীলনের এক ফাঁকেই বললেন, ‘অভিভাবকদের মানসিকতা অনেক বদলেছে। বিশেষ করে সৌম্য-মুস্তাফিজ জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পর এক রকম বিপ্লবই ঘটে গেছে সাতক্ষীরার ক্রিকেটে। সাতক্ষীরার ক্রিকেট ইতিহাসে এমনটা আগে কখনো দেখা যায়নি। বাবা-মায়েরা বড় আগ্রহ করে ছেলে-মেয়েকে ভর্তি করে দিচ্ছেন একাডেমিতে। সাতক্ষীরায় এখন চারটা একাডেমি। এক বছর আগেও এতগুলো একাডেমি ছিল না। 
সাতক্ষীরা জেলা বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে মুস্তাফিজুর রহমানের অংশগ্রহণের পেছনে যাঁর অবদান অগ্রগণ্য, আলতাফ হোসেনও রীতিমতো বিস্মিত সাতক্ষীরার ক্রিকেটের নবজাগরণে। যে গণমুখী ক্লাবের মাঠে হাতেখড়ি সৌম্য সরকারের, ক্লাবের ক্রীড়া সম্পাদক আলতাফ মুখে তৃপ্তির ঢেউ তুলে বললেন, ‘কদিন আগে বিকেএসপির খেলোয়াড় বাছাই কর্মসূচিতে প্রায় তিন হাজার খেলোয়াড় এসেছিল অংশ নিতে। অথচ আগে বড় জোর দুইশ খেলোয়াড় অংশ নিতে আসত। বিকেএসপির লোকজনও এমনটা দেখে তাজ্জব! এখন সবাই সৌম্য-মুস্তাফিজ হতে চায়। ক্রিকেটের প্রতি মানুষের এমন আগ্রহ সাতক্ষীরার ইতিহাসে আগে কখনো দেখা যায়নি। 
সামনে নতুন আরও সৌম্য-মুস্তাফিজ তুলে নিয়ে আসতে নানামুখী উদ্যোগের কথা জানালেন সংশ্লিষ্টরা। সাতক্ষীরা ক্রিকেট একাডেমির প্রধান মুফাচ্ছিনুল বললেন, ‘সারা বছর খেলোয়াড়দের খেলার মধ্যে রাখার চেষ্টা করি। বৃষ্টির মৌসুমে বোলিং-ফিল্ডিং না করা গেলে ফিল্ডিং বা ফিটনেস নিয়ে কাজ করি। মোটামুটি সব সময় কাজের মধ্যে থাকা হয়। 
গণমুখী ক্লাবের কর্মকর্তা আলতাফ জানালেন, ২০০২ এর পর প্রায় এক দশক ঝিমিয়ে পড়েছিল সাতক্ষীরার ক্রিকেট। তবে ২০১২ সালের পর থেকেই ছবিটা বদলাতে শুরু করেছে, ‘অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে প্রায় দশ বছর সাতক্ষীরার ক্রিকেট পিছিয়ে পড়েছিল। ২০১২ সালে নতুন কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার পর আবার গতি এসেছে। এখন নিয়মিত টুর্নামেন্ট-লিগ হচ্ছে। স্থানীয় ক্রিকেট উন্নয়নে টুর্নামেন্ট-লিগের বিকল্প নেই। সে টুর্নামেন্টগুলোয় জাতীয় দলের খেলোয়াড়েরাও অংশ নিচ্ছে। এতে স্থানীয় খেলোয়াড়েরা বড় বড় খেলোয়াড়দের সাহচার্য পাচ্ছে। অনেক কিছু শিখতে পারছে। 
সাতক্ষীরা ক্রিকেটের উন্নয়নে বেশ কিছু কার্যকরী উদ্যোগের কথা জানালেন জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক শেখ নিজাম উদ্দিন। বিসিবির সাবেক পরিচালক বললেন, ‘আমরা কাজে স্বচ্ছতা বজায় রাখার চেষ্টা করি। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটার বাছাইয়ে নানা জায়গা থেকে ফোন আসে, তদবির আসে। আমাদের কাছে পারফরম্যান্সটাই শেষ কথা। পারফরম্যান্স ভালো হলে সুযোগ পাবে, নইলে নয়। ছাড়া গ্রামের ছেলেদের অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়। কারণ, তারা নানা সমস্যা, বাধা-বিপত্তির মধ্য দিয়ে বড় হয়। একটু ভালো দিকনির্দেশনা সুযোগ-সুবিধা পেলে দারুণ পারফরম্যান্স করে। এখন আন্তজেলা ক্রিকেটে সাতক্ষীরা দলে গ্রামের ছেলেরাই বেশি ভালো করেছে। মুস্তাফিজও কিন্তু উঠে এসেছে গ্রাম থেকেই। 
নিকট ভবিষ্যতে সৌম্য-মুস্তাফিজের মতো আরও প্রতিভা কি পাবে বাংলাদেশ? ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিষ্কার কিছু বলা কঠিন হলেও সাতক্ষীরার ক্রিকেট-সংশ্লিষ্টরা আশার কথাই শোনলেন। মুফাচ্ছিনুল, আলতাফ শেখ নিজাম সমস্বরেই জানালেন, অনূর্ধ্ব-১৪ ১৬ দলে বেশ কজন প্রতিভাবান খেলোয়াড় আছে। দুই-চার বছর পর হয়তো একটা সুফল পাওয়া যেতে পারে। মুফাচ্ছিনুল বললেন, ‘ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ কিছু বলতে পারে না। তবে আমরা আশাবাদী, ভবিষ্যতে সাতক্ষীরার আরও কয়েকজন ক্রিকেটার ভালো পর্যায়ে যাবে। বেশির ভাগ কিশোর-তরুণেরা বড় খেলোয়াড় হতে চায়। সত্য হচ্ছে, সবাই তা হতে পারবে না। ভালো খেলোয়াড় না হতে পারলেও চাইলে ভালো মানুষ হওয়া যায়। ক্রিকেট কেবল মাঠের জন্য নয়, জীবনের জন্যও। ডিসিপ্লিন কাজে লাগে সারা জীবন। এখন সাতক্ষীরার কিশোর-তরুণেরা সুন্দর একটি জীবনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এটাও বা কম কীসে!’

Share this

0 Comment to "তৈরি হচ্ছে আগামীর সৌম্য-মুস্তাফিজরা"

Post a Comment