Tuesday 11 August 2015

একার সিদ্ধান্তে ৬০০ কোটি টাকা দিয়েছেন হাই

বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু একক সিদ্ধান্তে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন। এসব ঋণের ক্ষেত্রে যাচাই কমিটির প্রস্তাব ছিল না। কিছু ক্ষেত্রে আবার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঋণ যাচাই কমিটি আগেই প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছিল। তারপরেও সেগুলো আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু পরিচালনা পর্ষদের সভার কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করিয়ে ঋণ দিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁর মৌখিক সিদ্ধান্তেও ঋণ দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকিং ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা আর কখনোই শোনা যায়নি।
২০১২ ও ২০১৩ সালের বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত ব্যাংকের পাঁচটি বোর্ডসভার নথি পর্যালোচনা করে শাখা ও যাচাই কমিটিকে পাশ কাটিয়ে ঋণ অনুমোদনের সুনির্দিষ্ট এসব তথ্য পাওয়া যায়। এ ধরনের ঋণের পরিমাণ প্রায় ৫৭৫ কোটি টাকা। পাশাপাশি প্রস্তাব ছাড়াই পুনঃ তফসিল করা ঋণের পরিমাণ আরও প্রায় ২৫ কোটি টাকা।
শেখ আবদুল হাই ওরফে বাচ্চুর এভাবে ঋণ দেওয়ার ওই সব নথি বেসিক ব্যাংকেই রয়েছে। এসব তথ্য পর্ষদের কার্যবিবরণীতেও উল্লেখ আছে। অথচ এসব কিছুই খুঁজে পায়নি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ফলে আবদুল হাই ওরফে বাচ্চুকে ছাড়াই বেসিক ব্যাংকের অর্থ জালিয়াতির ঘটনায় অনুসন্ধান শেষ করেছে দুদক। ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তা রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী আবদুল হাই ওরফে বাচ্চুর নির্দেশে এসব ঋণ মঞ্জুর করেছেন, দুদক এখন কেবল তাঁদেরই চিহ্নিত করছে। অথচ মূল নির্দেশদাতা পাচ্ছেন দায়মুক্তি।
দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, বেসিক ব্যাংকে যে ঘটনা ঘটেছে, তার দায় সাবেক চেয়ারম্যান কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। প্রথমত, তিনি যথাযথ ব্যাংকিং প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। দ্বিতীয়ত, যেসব বেআইনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেগুলোও অপরাধ। এ ক্ষেত্রে নথিগত প্রমাণ পায়নি এমন অজুহাতে দুদক তাঁকে ছাড় দিতে পারে না। দুদক যদি তাঁকে বাদ দিয়ে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দেয়, সে ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো মহলের চাপে সেটা করছে কি না, সে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
বেসিক ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ব্যাংকের অধিকাংশ ঋণ মঞ্জুর, ঋণ নবায়ন এবং ঋণসংক্রান্ত অন্যান্য প্রস্তাবে সংশ্লিষ্ট শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের ঋণ যাচাই কমিটির কোনো সুপারিশ ছিল না। তারপরেও সেগুলো পর্ষদের সিদ্ধান্ত বা দিকনির্দেশনার জন্য সভায় উপস্থাপন করা হয়ে। আবার কোনো কোনো প্রস্তাবের ক্ষেত্রে প্রধান কার্যালয়ের ঋণ যাচাই কমিটি সুস্পষ্টভাবে নেতিবাচক মতামত দিলেও পর্ষদ ঋণগুলো অনুমোদন করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার ঋণ যাচাই প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ঋণ প্রস্তাব পর্ষদে উপস্থাপনের কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে না পেলেও সেগুলো ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। আবার সংশ্লিষ্ট শাখা আবদুল হাই বাচ্চুর মৌখিক নির্দেশেও ঋণ দিয়েছে।
এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে দুদকের কর্মকর্তারা সেই প্রথাগত বক্তব্যই দিয়েছেন। দুদকের কমিশনার (অনুসন্ধান) নাসির উদ্দীন আহমেদ গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, বোর্ডের অনিয়ম ও দুর্নীতি সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য-প্রমাণ পেলে কমিশন সেটা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবে।
প্রাপ্ত নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু চেয়ারম্যান থাকাকালে ব্যাংকের ৩১০, ৩১১, ৩১৩, ৩১৪ ও ৩২৪ নম্বর বোর্ডসভায় ২৪ প্রতিষ্ঠানকে অনিয়ম করে ঋণ দেওয়া হয়। যেমন ২০১২ সালের ৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বোর্ডের ৩১০ নম্বর সভায় ব্যাংকের গুলশান শাখার গ্রাহক এশিয়ান শিপিং বিডি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ৫০ কোটি টাকার মেয়াদি ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই সভাতেই একই শাখার গ্রাহক ফারদিন ফিশকে ঋণ অনুমোদন করা হয় ১৫ কোটি টাকা। ওই বছরের ২৭ জুন বোর্ডের ৩২৪ নম্বর সভায় গুলশান শাখার গ্রাহক মেগা ট্রেডার্সকে ৮৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা মেয়াদি ঋণ এবং ৮ কোটি টাকার ক্যাশ ক্রেডিট (হাইপো) অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই সভাতেই মেসার্স আনান সক্স, ওয়েল সোয়েটার্স, ওয়েল টেক্স লিমিটেডের স্বল্পমেয়াদি ঋণকে (ডিমান্ড লোন) মেয়াদি ঋণে পরিবর্তন করার অনুমোদন দেওয়া হয়।
১৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বোর্ডের ৩১১ নম্বর সভায় কারওয়ান বাজার শাখার গ্রাহক মনিকা ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনালের এসওডি (সিকিউরড ওভারড্রাফট) সীমা ৬৫ কোটি টাকা করার অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই সভাতেই গুলশান শাখার গ্রাহক এআরএসএস এন্টারপ্রাইজের এসওডি সীমা ৫০ কোটি, ঋণপত্র সীমা ১৫ কোটি এবং বিশ্বাসী ঋণ সীমা (এলটিআর লিমিট) ১০ কোটি করার অনুমোদন দেওয়া হয়।
২৩ মে অনুষ্ঠিত বোর্ডের ৩১৩ নম্বর সভায় বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের অনুকূলে ১৫ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দেয় পর্ষদ। সমন্বিত ঋণসুবিধা অনুমোদন দেওয়া হয় তারিফ অটো ফ্লোর মিলস (১০ কোটি), মিমকো কার্বন কোম্পানি (২৫ কোটি), বাংলাদেশ ইয়েলো পেইজেস লিমিটেডকে (১৪ কোটি ৭৫ লাখ)।
বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনা উদ্ঘাটনের পর থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক প্রতিবেদনে আবদুল হাই ওরফে বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতার কথা তুলে ধরা হয়। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও ব্যাংকটিতে ‘হরিলুটের’ পেছনে আবদুল হাই ওরফে বাচ্চু জড়িত বলে একাধিকবার উল্লেখ করেন। জাতীয় পার্টির নেতা হলেও উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগের কারণেই আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
এত তথ্য থাকার পরও দুদক কেন তাঁর বিরুদ্ধে নথিগত প্রমাণ পায়নি, সে বিষয়টি নিয়ে দুদকের দায়িত্বশীল কেউই মুখ খুলতে চান না। তবে না প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বাচ্চুর বিষয়ে ‘উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তের’ ওপরই নির্ভর করছে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হবে কি না।
তবে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, ‘অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে কমিশন কোনো অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে কাজ করছে না—আমি এটাই বিশ্বাস করতে চাই। আমি আশা করি, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে অনুসন্ধান করে প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করবে দুদক। কারণ, এর সঙ্গে অসংখ্য গ্রাহকের পাশাপাশি আমাদের জাতীয় স্বার্থ জড়িত।’
দীর্ঘদিন ‘কার্যত’ বন্ধ থাকা এবং বারবার অনুসন্ধান কর্মকর্তা বদলের পর ৪ আগস্ট প্রতিবেদন জমা দেয় দুদকের অনুসন্ধান দল। সেখানে আবদুল হাই ওরফে বাচ্চুর বিরুদ্ধে ‘নথিগত প্রমাণ’ না পেয়ে তাঁকে ছাড়াই ৫৬ জনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে বেসিক ব্যাংকের মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের মার্চে তা দাঁড়ায় ৯ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। ওই চার বছর তিন মাসে ব্যাংকটি ৬ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা ঋণ দেয়, যার প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকাই নিয়ম ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

Share this

0 Comment to "একার সিদ্ধান্তে ৬০০ কোটি টাকা দিয়েছেন হাই"

Post a Comment