Tuesday 11 August 2015

নতুন বেতন কাঠামো চূড়ান্তকরণে বিপত্তি

নতুন বেতন কাঠামো চূড়ান্ত করতে গিয়ে বিপত্তিতে পড়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। বেতন ও চাকরি কমিশনের সুপারিশের পর সচিব কমিটি এবং অর্থমন্ত্রী সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাদ দেওয়ার পক্ষ নেন; আবার তাঁরা বেতন কাঠামোতে ২০টি গ্রেডই চান। এতেই দেখা দিয়েছে বিপত্তি।
বেতন স্কেলের ৮, ৭ ও ৪ নম্বর গ্রেড সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেলপ্রাপ্তদের জন্য। এখন সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল যদি বাদ দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে কিভাবে ২০টি গ্রেড হবে! সেই পথটিই খুঁজে পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। আর এ কারণেই নতুন বেতন কাঠামো চূড়ান্ত করেও মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করতে পারছে না অর্থ মন্ত্রণালয়।
গত সপ্তাহে এক অনুষ্ঠান শেষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের বলেন, এ মাসের মধ্যেই নতুন বেতন কাঠামো মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হবে। তিনি আরো বলেন, যখনই জারি করা হোক না কেন, গত ১ জুলাই থেকেই এটি কার্যকর করা হবে। অর্থাৎ চাকরিজীবীরা বেতনের বকেয়া বর্ধিতাংশ পাবেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, বিদ্যমান বেতন স্কেলে বিসিএস উত্তীর্ণ কর্মকর্তারা যোগদান করেন ৯ নম্বর গ্রেডে। বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের পদ-পদবির ভিন্ন নাম হলেও প্রশাসনে তাঁরা মূলত সহকারী কমিশনার বা সহকারী সচিব হিসেবে যোগ দেন। এক ধাপ পদোন্নতি পেয়ে তাঁরা যখন সিনিয়র সহকারী সচিব হন তখন তাঁদের বেতন হয় ৬ নম্বর গ্রেডে। মাঝখানের ৭ ও ৮ নম্বর গ্রেডে সহকারী সচিবরা বেতন পান আসলে সিলেকশন গ্রেডে। ড. ফরাসউদ্দিন কমিশনের সুপারিশ, সচিব কমিটির অনুমোদন ও অর্থমন্ত্রীর আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সিলেকশন গ্রেড বাদ দিলে নতুন বেতন স্কেল থেকে ৭ ও ৮ নম্বর গ্রেড বাদ দিতে হয়। কিন্তু সচিব কমিটি ও অর্থমন্ত্রী এটাও চান যে নতুন বেতন স্কেলে ২০টি গ্রেডই থাকুক। এখানেই সংকট। কর্মকর্তারা মাথাকুটেও সিলেকশন গ্রেড বাদ দিয়ে ৭ ও ৮ নম্বর গ্রেড বহাল রাখার পথ বের করতে পারছেন না।
একই অবস্থা বেতন স্কেলের ৪ নম্বর গ্রেড নিয়ে। ৬ নম্বর গ্রেডের সিনিয়র সহকারী সচিবরা পদোন্নতি পেয়ে উপসচিব হন, তখন তাঁদের বেতন-ভাতা পৌঁছায় ৫ নম্বর গ্রেডে। আরেক দফা পদোন্নতি পেয়ে তাঁরা পৌঁছান ৩ নম্বর গ্রেডে- যুগ্ম সচিব পদে। মাঝখানের ৪ নম্বর গ্রেডটি হলো টাইম স্কেলপ্রাপ্তদের, যাঁরা যুগ্ম সচিব হননি তাঁদের জন্য। এই ৪ নম্বর গ্রেড বহাল রেখে টাইম স্কেল বাদ দেওয়ার উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাদ দিয়ে ২০টি গ্রেড রাখা যে সম্ভব নয়, তা উপলব্ধি করেই ড. ফরাসউদ্দিনের কমিশন ১৬টি গ্রেড প্রস্তাব করে। সে প্রস্তাবে দুটি গ্রেডকে একীভূত করা হয়, তাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিচের গ্রেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেশি লাভবান হয়, ওপরের গ্রেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ততটা লাভ হয় না। এতেও এক ধরনের সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা ছিল। ১৬টি গ্রেড হলে বেতন-ভাতা বাবদ সরকারের ব্যয়ও বাড়ত। এসব কারণেই সচিব কমিটি ও অর্থমন্ত্রী ২০টি গ্রেড বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। কিন্তু টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাদ দিয়ে কিভাবে তা সম্ভব সে কথা কেউ বাতলায়নি।
এদিকে বেতন কাঠামো চূড়ান্ত করতে দেরি হওয়ায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মনে ভিন্ন ধারণা জন্ম নিচ্ছে। তাঁরা মনে করছেন, সরকার ইচ্ছা করেই নতুন বেতন কাঠামো অনুমোদন ও কার্যকর করতে দেরি করছে। আগামী সেপ্টেম্বরে ঈদুল আজহায় যাতে নতুন কাঠামো অনুযায়ী উৎসব বোনাস দিতে না হয়, সে জন্যই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছে না সরকার। তাঁরা মনে করছেন, ১ জুলাই কার্যকর ধরা হলেও উৎসব ভাতার ক্ষেত্রে বকেয়া পাওয়ার সুযোগ থাকবে না।
সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) সমন্বয় কমিটির উদ্বেগ : সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাদ দেওয়ার বিষয়ে উদ্বিগ্ন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) সমন্বয় কমিটি। গত ৬ আগস্ট কমিটির বৈঠকে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বহাল রাখার দাবি জানানো হয়েছে। বিদ্যমান বেতন স্কেলের মতো সচিবদেরও ১ নম্বর গ্রেডে বেতন-ভাতা দেওয়ার দাবি জানান কমিটির সদস্যরা। বৈঠকে এ-সংক্রান্ত একটি আবেদন মন্ত্রিপরিষদসচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূঁইঞা ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মাহবুব আহমেদকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
বিদ্যমান বেতন কাঠামো অনুযায়ী, সচিবরা ১ নম্বর গ্রেডে নির্ধারিত ৪০ হাজার টাকা বেতন পান। নতুন বেতন কাঠামোতে ১ নম্বর গ্রেডের বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৫ হাজার টাকা। কিন্তু সচিবদের ১ নম্বর গ্রেডের ঊর্ধ্বে বসিয়ে তাঁদের বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। এটা মানতে পারছেন না বিসিএস সমন্বয় কমিটির নেতারা।
ওই আবেদনপত্রে কমিটি বলেছে, ২০১৫ সালের প্রস্তাবিত বেতন স্কেলে গ্রেড-১-এর ওপরে অতিরিক্ত তিনটি বেতনস্তর বসিয়ে নতুন করে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে, যা বিভিন্ন ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য খুবই অমর্যাদাকর এবং এটা প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।
বিসিএস সমন্বয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. কবির আহমেদ ভূঁইয়া ও মহাসচিব মো. ফিরোজ খান স্বাক্ষরিত আবেদনপত্রে আরো বলা হয়, ১৯৮০ সালের বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস আইনে সব ক্যাডারের সমমর্যাদার কথা বলা হলেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিভিন্ন সময়ে তা লঙ্ঘন করে প্রশাসন ক্যাডারকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে। ১৯৮৫ সালের ৩০ জুন অর্থ বিভাগের বাস্তবায়ন শাখার একটি নোটিফিকেশনে প্রতিটি ক্যাডারের কমপক্ষে একজন কর্মকর্তার গ্রেড-১-এ বেতন পাওয়ার কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীকে এসব তথ্য জানানো হলে ২০১২ সালের ৩১ জুলাই ১৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠিত হয়। ওই কমিটির সুপারিশে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৩০টি অধিদপ্তর, সংস্থা ও করপোরেশনের প্রধানের পদ গ্রেড-১ এবং ২০টি প্রতিষ্ঠানের প্রধানের পদ গ্রেড-২-এ উন্নীত করে আদেশ জারি করে। এতে গ্রেড-১-এর স্বীকৃতি পাওয়া প্রধানরা সচিব মর্যাদার হন। কিন্তু এখন সচিবদের জন্য আলাদা গ্রেড করা হয়েছে এবং আগের বৈষম্যই টিকিয়ে রাখা হচ্ছে।

Share this

0 Comment to "নতুন বেতন কাঠামো চূড়ান্তকরণে বিপত্তি"

Post a Comment