Friday 7 August 2015

রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ

অনুবাদ একটি স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যম। কবিতা নাটক উপন্যাস প্রবন্ধ ইত্যাদির মতো এরও রয়েছে একটি স্বতন্ত্র এলাকা যা ওইসব মাধ্যমের মতোই নানা উপকরণে বৈশিষ্ট্যে পূর্ণ। যদিও অনুবাদ বিপুলাংশে স্থাপিত হয় কোনো একটি উৎস মাধ্যমের ওপরই, এবং সেই উৎসবে একটি লক্ষ্যভাষায় রূপান্তরিত করাই অনুবাদের কাজ, তবু অনুবাদও বিবেচিত হয় একটি সৃজনশীল শিল্পমাধ্যম হিসেবে। মূলের কতটা অনুগামী হলে শিল্প হিসেবে অনুবাদ উতরে যাবে বা ব্যর্থ হবে সেই নির্বাচন ক্ষমতার ওপরই প্রকাশ পায় অনুবাদের সৃজনশীলতা।
রবীন্দ্রনাথ মূলত একজন কবি; বস্তুত তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রধান এবং বহুমাত্রিক সৃজনশীল প্রতিভা হিসেবে অনন্য। এই সাহিত্যের সব শাখা তাঁর প্রতিভার সংষ্পর্শে দারুণভাবে আন্দোলিত হয়েছে। মূল ইংরেজি ভাষায় তাঁর লেখা নেহায়েত স্বল্প নয়। আবার বাংলা থেকে ইংরেজিতে এবং ইংরেজি, ফরাসী, জার্মাণ থেকে বাংলায় অনুবাদের কাজেও তিনি যথেষ্ট সময় দেন। সৃজনশীল সাহিত্যিক অনুবাদকর্মে নিয়োজিত হলে সাধারণত ব্যর্থই হন কারণ অনুবাদে নিজের কল্পনা ও মাধুরি মেশানোর প্রবণতা তাঁকে মূল থেকে ক্রমে বহু দূরে তাড়িয়ে নেয়। তখন অনূদিত কর্মটিকে অনুবাদ না বলে তাঁর নিজস্ব রচনা বললেই যথার্থ হয়। উদাহরণ দেওয়া যায় শেক্সপীয়র, ড্রাইডেন, পোপ থেকে। উৎস কাহিনীতে ভর করে শেক্সপীয়র তাঁর নাটকগুলোয় কি দারুণ সব কান্ডই না করে বসেছেন। অন্যদিকে, ড্রাইডেন, পোপ–ওঁরাও হোমার ভার্জিল অনুবাদ করতে গিয়ে এমন কর্ম উপস্থাপন করলেন যে সেখানে গ্রীস ও ইতালির হতভাগ্য কবিদের আর চেনাই যায় না। বেশি সৃজনশীল কবি সাহিত্যিকের পক্ষে তাই সার্থক অনুবাদ অর্থাৎ যাতে মূল বজায় থাকবে আবার নতুন একটি শিল্পকর্মও রচিত হবে-এমন ঘটনাকর্মই ঘটে থাকে।
এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথকে কিছুটা ব্যতিক্রমীই মনে হয়। সাহিত্যে বিপুল, বিস্ময়কর কর্মযজ্ঞের স্রষ্টা এই মানুষটি অন্যান্য শাখার মতো বৃহদায়তনে অনুবাদ না করলেও তাঁর মূল ইংরেজি লেখা এবং ইংরেজিতে নিজের কবিতার অনুবাদও নেহায়েত কম করেননি। মূলের কাছাকাছি থেকেও যে ইংরেজি বেশ পাঠযোগ্য শিল্পসৃষ্টি করা যায় তা রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের কবিতা এবং গদ্যরচনার ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশ করেছেন। তাঁর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত কাব্যসংগ্রহ গীতাঞ্জলির কবিতাগুলো তিনি নিজেই ইংরেজিতে অনুবাদ করেন এবং তার পান্ডুলিপি পকেটে নিয়ে ইংরেজ কবি ইয়েটস দিনের পর দিন বাসে, ট্টেনে, রেস্তোরাঁয় ঘুরে বেড়াতেন আর থেকে থেকে খুলে পড়তেন। ইয়েটস গীতাঞ্জলির ভূমিকায় ১৯১২সালের সেপ্টেম্বরে বলছেন কবিতাগুলোর সজীবতা, আধ্যাত্মিকতায় তিনি এতোই অভিভুত হয়েছিলেন যে তাঁকে ঘন ঘন পান্ডুলিপি বন্ধ করতে হয়েছে পাছে তার অভিভূত অবস্থা কেউ দেখে ফেলে। ভারতীয় বন্ধুদের কাছে ইয়েটস রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শোনেন এবং তাঁর অনূদিত কবিতা পড়েও প্রথম মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে হতাশার মধ্যে আশার আলো দেখতে পান। সেসময় সমগ্র ইউরোপই যে আশাহত বন্তুবাদী পাঁকে নিমজ্জিত হয়েছিলো তার প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি ও প্রেম ও আধ্যাত্মিক জীবন সম্পর্কে রচনাগুলি ইয়েটসকে অন্তত: কিছুদিনের জন্য খুব মুগ্ধ করেছিলো।
এখন রবীন্দ্রনাধ যে নিজেই গীতাঞ্জলির কবিতাগুলোর ইংরেজি সংস্করণ করলেন সে সম্পর্কে পরবর্তীকালে অনেকেই নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। এব্যাপারে বেশ জোরালো ভাষায় লিখেছেন হালাম টেনিসন। রবীন্দ্রনাথের ওপর লেখা প্রবন্ধে এই ইংরেজ সমালোচক ও প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন যে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ইউরোপের উম্মাদনা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছুটা আগে ও পরে বহাল ছিলো। কিন্তু এরপর থেকে ওই উৎসাহে ভাটা পড়ে এবং এই ভাটার বীজ নিহিত ছিলো রবীন্দ্রনাথের নিজের অনুবাদেই। ইংল্যান্ডে যাওয়ার সময় জাহাজে সময় কাটানোর জন্য তিনি এই অনুবাদগুলো করেন। টেনিসন বলছেন যে রবীন্দ্রনাথ বাংলার মূল থেকে অনুবাদ করেননি, বরং একগুচ্ছ কবিতা পড়ে যেটুকু মনে থাকতো তারই ভাবানুবাদ করতো ছন্দমাত্রা পরিসর ইত্যাদির কোনো তোয়াক্কা না করে। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তাঁর ইংরেজি ভাষায় দখলের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন বলেই গীতাঞ্জলি আগে সর্বসমক্ষে প্রকাশ করতে চাননি। তবে ইয়েটস এবং তাঁর বন্ধুদের মধ্যে কবিতাগুলি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেলে তিনি আত্মবিশ্বাস লাভ করেন। তাঁর মনে হয় যেন পশ্চিম তার জন্য দুয়ার খুলেছে এবং সেখানে মিলন ঘটছে প্রাচ্যপাশ্চাত্যর উভয়েরই। এতোটা আত্মবিশ্বাস সৃষ্টির মুখে কিন্তু তাঁর নিজের করা গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদই।
আসলে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি অনুবাদে যে খুব বেশি স্বাধীনতা নিয়েছেন তা নয়। আর তাঁর অনুবাদ যদি এতোই খারাপ হবে তো ইউরোপ তো তাঁকে চিনলো এবং তাঁর সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো এই অনুবাদের মাধ্যমে। বস্তুত হালাম টেনিসনই জানাচ্ছেন যে গীতাঞ্জলির ইংরেজি সংস্করণ প্রথম দু বছরেই কুড়িবার ছাপাতে হয়েছে এবং এই সাফল্যে ইংরেজ প্রকাশকরা সেসময় তাঁকে দিয়ে কিছু ইংরেজি কবিতার বইও লিখিয়ে নিয়ে প্রকাশ করে, যেমন ১৯১৯ সালে এই এরকম আটটি বই প্রকাশিত হয়। সেসময় শান্তিনিকেতনের জন্য অর্থের প্রয়োজন ছিলো বলে রবীন্দ্রনাথও এসব ফরমায়েসি লেখা লেখেন। তবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মূল ইংরেজি কবিতা সম্পর্কে কোনোরকম উচ্চাশা পোষণ করতেন না। টেনিসন তাঁর প্রবন্ধে লিখেছেন, “১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বন্ধু ও জীবনীকার এডওয়ার্ড টমসনকে তাঁর ইংরেজির উন্নতি করতে অনুরোধ করে বলছেন, “আমার অনুবাদকে সহজ সরল স্বচ্ছ করতে যত বাধা সব এড়াতে চাই। প্রথম যখন নিজের লেখা নিয়ে এরকম মিথ্যাচার শুরু করি তখন তা করেছিলাম খেলাচ্ছলেই। কিন্তু এখন ব্যাপারটা এতোটাই বিশাল আকার ধারন করেছে যে আমার তো ভয়ই হচ্ছে এবং এখন নিজের দুষ্কর্মের স্বীকারোক্তি করতেও আমি প্রস্তুত। কিন্তু ততদিনে একটু দেরীই হয়ে গেছে কারণ রবীন্দ্রনাথের কবিখ্যাতি যেমন আলোর ঝলকানিতে ঝলমল করে উঠেছিলো তেমনি তা হঠাৎ করেই বাতাসে মিলিয়ে গেল। আজ আর কোনো প্রকাশকই তাঁর ইংরেজি লেখা প্রকাশের ঝুঁকি নিতে কিংবা তিনি নিজের টুটাফাটা অনুবাদের মাধ্যমে যে ক্ষতিটা করেছেন তা সারাতে তাঁর ইংরেজি লেখা ছাপাতে চাইবে না।” গীতাঞ্জলির একটি কবিতা “চিত্ত যেথা ভয় শূন্য, উচ্চ যেথা শির”-এর অনুবাদ নিয়ে টেনিসন কিছুটা বিস্তৃত আলোচনা করেন। ওই কবিতার শেষ দুটি চরণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ওই দুই লাইনের ( নিজহস্তে নির্দয় আঘাত করি পিত:/ ভারতের সেই স্বর্গে করো জাগরিত) আবেগঘন প্রকাশ রবীন্দ্রনাথের অনুবাদে ( where the mind is had forward by the into ever wandering thought and action / into that of freedom, my Father hit my country awake) একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। টেনিসন নিজেই ওই দুই চরণের অনুবাদ করে দেখান যে ইংরেজিতেও বাংলার সেই তেজ প্রকাশ করা সম্ভব: Strikes Father/ merciless , strike with this own hand! / into that Haven wake this Indian land. হয়তো শেষের অনুবাদ কিছুটা তেজী, কিন্তু বিদেশী একটি ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে ভাষাগত দুর্বলতা কিছুটা প্রকাশ পেতেই পারে।
আরেকটি কবিতার ( জানি এ দিন যাবে, এ দিন যাবে.. . ) দৃষ্টান্ত দিয়ে টেলিসন বলেন যে প্রায় আক্ষরিক অনুবাদেও কবিতাটি তার মূল বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে পারতো। যেমন, I know this day will pass, / This day will pans-/ That are day, some day,/ The dine sum with tender smiling /Will look into my face/ His last farewell/ Beside the road the flute will sound,/ The hands will gauge on the river lank, / The children will play in their Court yards, / The binds will sing on,/ lit this day will pans, \ This day will pans .সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ অনুবাদকে দীর্ঘায়িত এবং এলায়িত করে লিখলেন: i know that at the dine end of some day the sum will bid me its last farewell shepherds will play this piper beneath the Baragun trees, and Cattle orange on the stage by the rivers, While my days will pans into the dark”

রবীন্দ্রনাথ গদ্যেই অনুবাদ করলেন তাঁর কবিতাগুলি। হয়তো একজন বাংলা জানা ইংরেজ কবির হাতে পড়লে ওই কবিতাগুলি যথার্থ ইংরেজি কবিতাই হয়ে উঠতো। (কিন্তু তা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ দিয়েই তো গীতাঞ্জলি ইউরোপে পরিচিত হয়ে ওঠে। বলা হয় মহৎ কবিতার অনুবাদ হয় না, কিংবা যেমন ফ্রস্ট বলেছেন, অনুবাদে কবিতার মৃত্যু ঘটে। বস্তুত উৎস ভাষার যেসব সূক্ষ্ম প্রকাশ, রস, উৎপ্রেক্ষা, উপমা–সেসবের সাদৃশ্য বা লক্ষ্য ভাষায় না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এজন্য কবিতার অনুবাদে, যেমন অষ্টাভিও পাজ বলেন, সাধারণত নতুন একটি কবিতার জম্ম হয়। রবীন্দ্রনাথ ইংরেজিতে অনুবাদ করতে গিয়ে নতুন কবিতার জম্ম দিতে পারেননি বলেই হয়তো তার বাংলা গান ও কবিতাবলি হয়তো বিদেশী ভাষায় অনেকটাই খোড়া হাঁসের মতো চলে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই অনুবাদ দিয়েই তা রবীন্দ্রনাথ বিশ্বজয় করেছেন, বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সংস্কৃতিতে পৌঁছে গেছেন। তবে তাঁর যে দর্শন বিশেষ করে কবিতায় তা হয়তো খুব উন্নত অনুবাদে ভর করলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে পাশ্চাত্যের কাছে সমাদৃত হতো না। এজন্য হালাম টেনিসন যে বলছেন রবীন্দ্রনাথের নিজের অনুবা গুলো ঠেলে একপাশে সরিয়ে কোনো ইংরেজ কবি যদি মূলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত কোনো বাঙালির সাহায্যে অনুবাদ করতেন তো রবীন্দ্রনাথ হয়তো বিশ্বসাহিত্যে গ্যায়টের স্তরের এক দূর মহীরুর হিসেবে বিবেচিত হতো। সে কথার উপযোগিতা খুব একটি নেই, কারন তাঁর টুটাফাটা অনুবাদ দিয়েই রবীন্দ্রনাথ বিশ্বসাহিত্যে যেটুকু স্থান পাবার তা পেয়েছেন।
নিজের লেখা কবিতার অনুবাদ ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি ও বাংলায় আরো বেশ কিছু অনুবাদ করেছেন। কবীরের অনেকগুলো হিন্দি গান (প্রায় ১০০ টা) তিনি সম্ভবত বাংলা অনুবাদ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।

Share this

0 Comment to "রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ"

Post a Comment