Thursday 13 August 2015

সরকারি চালে ৬৬০ কোটি টাকা নেতাদের পকেটে!

বাজারে চালের দাম ২৬ টাকা কেজি। সেই চালই খাদ্য অধিদপ্তর কিনছে ৩২ টাকা কেজি দরে। বাজার থেকে কিনে কোনো রকমে সরকারি গুদামে পৌঁছাতে পারলেই কেজিতে লাভ ছয় টাকা। খাদ্য অধিদপ্তর ১১ লাখ টন চাল কিনবে। কাজেই প্রতি কেজিতে ছয় টাকা হিসাবে প্রায় ৬৬০ কোটি টাকা জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের পকেটে চলে যাবে। কারণ তাৎক্ষণিক লাভের এই কারবারটি একচেটিয়াভাবে করছে ক্ষমতাসীন দলের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।
অথচ এ চাল সরবরাহ করার কথা মিল মালিকদের। কিন্তু নেতাকর্মীদের দাপটে মিলাররা চাল সরবরাহ করতে পারছেন না। আবার স্থানীয় বাজার থেকে কেনা এসব চাল মানসম্পন্নও নয়। অথচ সরকারি গুদামে ঢোকাতে হলে চালের আর্দ্রতা, ভাঙা চালের পরিমাণসহ বিভিন্ন নির্দেশনা মানতে হয়। রাজনৈতিক নেতারা সেই নির্দেশনা না মেনেই চাল নিতে বাধ্য করছেন স্থানীয় খাদ্য কর্তৃপক্ষকে। নিম্নমানের চাল গ্রহণ করতে আপত্তি করলেই জেলা-উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তাদের ওপর নেমে আসছে নির্যাতন। কিল, ঘুষি থেকে শুরু করে খাদ্য কর্মকর্তাদের কর্মস্থল থেকে মেরে নিজের জেলায় পাঠিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। ভয়ভীতি দেখিয়ে কাজ না হলে রক্তাক্ত ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। মাঠপর্যায়ের রাজনৈতিক নেতারা এসব ঘটনা ঘটালেও পরিস্থিতি জটিল হলে নেপথ্য থেকে বের হয়ে আসেন মন্ত্রী-এমপিরা। এ পর্যন্ত সাত জেলার ১১টি খাদ্যগুদামের কর্মকর্তাদের শারীরিকভাবে নাজেহাল করা হয়েছে।
ময়মনসিংহ জেলার সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক (কারিগরি) মো. আলাউদ্দিনকে গত ২৮ জুলাই মেরে রক্তাক্ত করা হয়। আরো তিনজন আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় দ্রুত বিচার আইনে মামলা হয়েছে। মামলায় স্থানীয় শ্রমিক লীগ সভাপতি আনোয়ার হোসেনকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। আনোয়ার হোসেনের আরো ১০ সহযোগীকে আসামি করা হয়েছে। এজাহারে আলাউদ্দিন বলেছেন, আনোয়ারের নেতৃত্বে  কিল-ঘুষি মেরে তাঁকে রক্তাক্ত করা হয়। এ সময় গুদামের অন্য কর্মকর্তারা এগিয়ে এলে তাঁদেরও মারধর করা হয়। এ ছাড়া কারিগরি খাদ্য কর্মকর্তা শরিফা আক্তার শিমুকে গালাগাল করে খাদ্যগুদাম থেকে বের করে দেওয়া হয়। খাদ্যগুদামে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য তাঁদের সবাইকে একটি কক্ষে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়।
একই কারণে গত ৯ জুন হবিগঞ্জের খাদ্য পরিদর্শক আবদুল বারেককে লাঞ্ছিত করা হয় এবং প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হলে তিনি থানায় জিডি করেন। এরপর তাঁকে আপসে যেতে বাধ্য করা হয়। গম কেনা নিয়ে গত ১৮ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার গাংনী খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফুলজামাত আলীকে মারধর করে আহত করা হয়েছে। এ ঘটনায়ও মামলা করলে আপসের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। গত ২ জুলাই জয়পুরহাট জেলার সদর উপজেলার খাদ্যগুদামের সংরক্ষণ ও চলাচল কর্মকর্তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। পরে আপসে বাধ্য করা হয়েছে। গত ২৩ জুন পাবনা জেলার বড়ালব্রিজ খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরিতোষ কুমারকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। ২৫ জুন পাবনা সদর উপজেলার খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহীনুর আলমকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। গত ২০ জুন নাটোর জেলার সদর খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামানকে গুলি করা হয়েছে। তিনি ভয়ে মামলা করতে যাননি। রাজশাহী জেলার পুড়িয়া খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলামকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। একই দিনে নওহাটা খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান লাঞ্ছিত হন। গত ৬ মে রাজশাহী জেলার তানোর খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মইনুল হোসেনকে লাঞ্ছিত করা হয়। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ক্ষেতুর রোড খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এমাজউদ্দিনকে কুপিয়ে জখম করা হলে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
খাদ্য পরিদর্শক সমিতির সভাপতি আব্দুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা নিরাপদে সরকারি দায়িত্ব পালন করতে চাই। কিন্তু যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে সেটা করতে পারছি না। খাদ্য পরিদর্শকসহ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কাজ করছেন। নির্দিষ্ট করে আসামির নাম দিয়ে মামলা করার পরও তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। উল্টো মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। ইরি-বোরো ধান ও চাল এবং গম সংগ্রহের সময় ১১টি সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছে। এসব সন্ত্রাসী হামলায় ১৪ জন কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। তিনজন কর্মকর্তাকে রক্তাক্ত করা হয়েছে। এসব ঘটনার বেশির ভাগই স্থানীয়ভাবে আপসরফা করতে বাধ্য করা হচ্ছে। মামলা হলেও তা প্রত্যাহারের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে।’
বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির সভাপতি লায়েক আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা মিলারদের মাধ্যমেই সরকারি গুদামে চাল দিচ্ছে। এই চাল সরবরাহে এক ধরনের অরাজকতা চলছে। এখানে অনিয়মই নিয়মে পরিণত হয়েছে। এ বিষয়ে আর কিছু বলতে চাই না।’
দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলার ঘটনার প্রতিবাদ করার জন্য খাদ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন সংগঠন এক হয়ে একক সংগঠন ‘খাদ্য বিভাগীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ’ গঠন করেছে। খাদ্যগুদামের কর্মকর্তাদের ওপর এসব নির্যাতনের প্রতিবাদে গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর খাদ্য অধিদপ্তরে বিক্ষোভ করেছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এতে রাজধানীর বিভিন্ন খাদ্যগুদামের কর্মকর্তারাও যোগ দেন। বিক্ষোভ শেষে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফয়েজ আহমদকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়।
স্মারকলিপিতে ময়মনসিংহে হামলার ঘটনা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘সর্বশেষ ০৭-০৮-২০১৫ তারিখে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও ময়মনসিংহ জেলা খাদ্য পরিদর্শক সমিতির নেতাদের ডেকে নিয়ে ধর্মমন্ত্রীর ভাই পরিচয় দানকারী দুই ব্যক্তি অকথ্য ভাষায় গালাগাল এবং শুক্রবারের মধ্যে মামলা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়; অন্যথায় বাদীসহ অন্য কর্মকর্তাদের ময়মনসিংহ থেকে মেরে বিতাড়িত করার হুমকি দেওয়া হয়েছে।’
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিক্ষোভ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফয়েজ আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে ইস্যুতে আন্দোলন করছে তা খাদ্য মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। আমি তাদের ধৈর্য ধরতে বলেছি।’
চলতি বোরো মৌসুমে খাদ্য অধিদপ্তর ১১ লাখ টন বোরো চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। প্রতি কেজির দর নির্ধারণ করা হয়েছে ৩২ টাকা। গত ১ মে থেকে বোরো সংগ্রহ করছে খাদ্য অধিদপ্তর। এ সংগ্রহ অভিযান চলবে আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। গত সোমবার পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার ৬৫ ভাগ বোরো চাল সংগ্রহ হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। অথচ খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, যে মানের চাল সংগ্রহ চলছে সেই মানের চালই বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৬ টাকা কেজি দরে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের গত ১১ আগস্টের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতির সারসংক্ষেপেও বলা হয়েছে, বাজারে মোটা চাল ২৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। কয়েক সপ্তাহ ধরেই এই দরে চাল বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন জেলার ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বাজার থেকে এসব চাল কিনে সরকারি খাদ্যগুদামে সরবরাহ করছে। ২৬ টাকায় এসব চাল কিনে গুদামে দেওয়া হচ্ছে ৩২ টাকা দরে। অনেক জেলা-উপজেলায় টিআর কর্মসূচির চাল আরো কম দামে কিনে এগুলো চড়া দামে সরকারি গুদামে সরবরাহ করা হচ্ছে। টিআর কর্মসূচির চাল সাধারণত ২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করে ওই টাকা দিয়ে টিআর প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়।

Share this

0 Comment to "সরকারি চালে ৬৬০ কোটি টাকা নেতাদের পকেটে!"

Post a Comment