Saturday 8 August 2015

মধ্যবর্তী নির্বাচনে ‘বিদেশি চাপ’ থাকলেও মেয়াদ শেষ করাই সরকারের টার্গেট

মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে নতুন করে বিদেশি চাপে পড়েছে সরকার। আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা এমনই আভাস দিয়েছেন। রাজনীতির অন্দরমহলে এ নিয়ে আলোচনাও চলছে বলে নাম গোপন রাখার শর্তে জানিয়েছেন কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা। তবে চাপ যা-ই থাকুক, সেটাকে ঠেকিয়ে পূর্ণ মেয়াদ (২০১৯ সাল) ক্ষমতায় থাকার নানা কৌশল গ্রহণ করেছে ক্ষমতাসীনরা। কৌশলের তালিকায় আছে জঙ্গি-সন্ত্রাসী ইস্যু। এটাকে সামনে তুলে ধরে আপাতত চাপ মোকাবেলা করছে সরকার। পাশাপাশি নিয়মিত বিরতিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির কথা তুলে বিদেশিদের সুনজরে আসার চেষ্টাও করবে সরকার।
জানা গেছে, মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে বেশি উৎসুক যুক্তরাষ্ট্র। আর এ কাজে তারা ভারতকেই তুরুপের তাস বিবেচনা করছে। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে জাতিসংঘের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর মধ্যস্থতায় বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ও তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপির মধ্যকার বৈঠকের আলোচনার বিষয়বস্তুকেও সামনে আনতে চায় ওবামার সরকার।
জানা যায়, তারানকোর সঙ্গে দুই দলের ওই বৈঠকে প্রতিশ্রুতি ছিল সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর দ্রুত সময়ের মধ্যে সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে আরেকটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের। অবশ্য মাঠের রাজনীতিতে বিএনপির অপারঙ্গম অবস্থানের কারণে সরকার এখন এ ইস্যুতে একেবারেই নমনীয় নয়। আর এখন অনেকটা হঠাৎ করেই বেড়েছে চাপ।
আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের সবাই বিষয়টি স্বীকার করছেন যে মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো ভারতের মাধ্যমে সরকারকে চাপে ফেলার চেষ্টা করছে। তবে নেতারা জোর দিয়ে বলেন, সে নির্বাচনও হবে সাংবিধানিকভাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই। আর সেটাও ২০১৭ সালের আগে নয়।
জানা গেছে, ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিনিধি দল গত মাসের শেষের দিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। মন্ত্রীর বেইলী রোডের বাসায় ভারতের এ প্রতিনিধি দল বৈঠক করেন। সেখানে মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে কথা উঠলেও আশরাফের পক্ষ থেকে কোনও সদুত্তর মেলেনি। এদিকে ৭ আগস্ট শুক্রবার সন্ধ্যায় ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির তিন নেতার সঙ্গে সৈয়দ আশরাফের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান সরকারের বন্ধু হিসেবে পরিচিত ভারতকে বাংলাদেশে একটি ‘গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচনের ব্যাপারে উদ্যোগী হতে পরামর্শ দিয়েছে। তবে ভারত সরকার এখনও বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের দুই মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর দুই নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে এসব  তথ্য নিশ্চিত করেন।
কয়েকজন নেতা চাপের কথা স্বীকার করলেও মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে বিদেশি চাপকে ‘গুজব ও গুঞ্জন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিদেশিরা কী চাপ দেবে! আর চাপ আছে এটা ঠিক, কিন্তু বিএনপিকে আগে তার রাজনীতি ঠিক করতে হবে। জঙ্গীবাদী ও উগ্রবাদী রাজনীতি থেকে সরে আসতে হবে। এগুলো বাদ দিয়ে এলে দেখা যাবে। আমি মনে করি না ইউরোপ-যুক্তরাষ্ট্র যার কথাই বলেন না কেন এখানে নির্বাচন নিয়ে এই জঙ্গীবাদকে ক্ষমতায় আনার মতো ভুল করবে। তিনি বলেন, তারা কারো সাথে দেখাটেকা করে কথা বলাতে পারে কিন্তু নির্বাচন আদায় করার অবস্থা নেই।’
জানা গেছে, নির্বাচন ইস্যুতে বিদেশিদের মনোভাব আঁচ করতে পেরে বিএনপি বিষয়টি নিয়ে বক্তব্য বিবৃতি দিতে শুরু করেছে। বিপরীতে সরকারি দলের পক্ষ থেকেও তার প্রতুত্তর দেয়া হচ্ছে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে টানা তিন মাসের আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার পরে মাস তিনেকের বিরতি দিয়ে একই ইস্যুতে বিএনপি আবারো রাজনৈতিক মাঠে ফিরে আসতে শুরু করেছে।
অবশ্য সরকারি দল এখনও আশাবাদি- দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ‘আন্দোলনে ব্যর্থ’ বিএনপির দুর্বল সাংগঠনিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে সরকার তার পুরো মেয়াদ শেষ করে ২০১৯ সালে নির্বাচন করতে পারবে। সরকার এও ধরে নিয়েছে- ৫ বছর পর অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে অনুষ্ঠিত হলেও বিএনপি তাতে অংশ নেবে। কারণ, পরপর দু‘টি নির্বাচন বয়কট করলে নির্বাচন কমিশনে তাদের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। বিএনপির মতো বড় দল এ ঝুঁকি নেবে না বলেই তাদের ধারণা।
জাতিসংঘ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে নতুন একটি নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি ছিল এমনটা স্বীকার করে তারানকোর সাথে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রতিনিধিত্বকারীদের একজন দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ওই সময় বলা হয়েছিল এই নির্বাচনটা হয়ে যাক তারপর আবার নির্বাচন হবে। কিন্তু বিএনপি তো সেই শর্ত মানেনি। তারা নির্বাচন বর্জন আর প্রতিহত করতে গিয়ে ওই শর্তটি ভঙ্গ করেছে। কাজেই ওই বিষয়টির সিদ্ধান্ত ওইখানে হয়ে গেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজি জাফরউল্যাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের ওপর বিদেশি চাপ আছে এমন একটি গুজব আছে। তবে এর ভিত্তি আছে বলে আমি মনে করি না।’
দলের সভাপতিমণ্ডলীর অপর এক সদস্য ও সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মো. নাসিম বলেন, এ ধরনের চাপ অনেক সময় আসতে পারে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করার সময়ও এ ধরনের চাপ দেখেছি। কিন্তু কোনও চাপের কাছে ‍মাথা নত করার নেত্রী নন শেখ হাসিনা।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবউল আলম হানিফ বলেন, মধ্যবর্তী নির্বাচনের কোনও সম্ভাবনা নেই। বিদেশি চাপ গুজব ছাড়া কিছুই নয়।
এদিকে দিল্লি থেকে বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিনিধি জানাচ্ছেন, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রর যে রাজনৈতিক এজেন্ডা আছে সেটা তারা যে গত বেশ কিছুকাল ধরে ভারতের মাধ্যমেই অর্জন করতে চাইছে – সাউথ ব্লকের কর্মকর্তারা তা একান্ত আলোচনায় স্বীকারও করছেন। কিন্তু প্রকাশ্যে তাদের অবস্থানটা খুব সোজাসাপটা, ‘ভারত বিশ্বাস করে বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার আছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারত কখনও হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না।’
টিভি চ্যানেলের জন্য কর্মকর্তারা এ ধরনের কথা বললেও ক্যামেরার বাইরে তারা এ কথাও স্বীকার করছেন যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দেখতে চায়। বিএনপি-সহ সব দলের অংশগ্রহণে এমন একটা নির্বাচন করার জন্য (যেটা ২০১৯-এ নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই করতে হবে) ভারত যাতে শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে কথা বলে, ওয়াশিংটন ইতিমধ্যেই দিল্লিকে সেই অনুরোধ জানিয়েছে। কূটনৈতিক চ্যানেলে, ও অন্যভাবেও।
সমস্যা হলো, মধ্যবর্তী নির্বাচনের এখনই কোনও প্রয়োজন আছে ভারত নিজেরাই সেটা বিশ্বাস করে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলছিলেন, ‘আমরা নিজেরাই যেটা নিয়ে কনভিন্সড নই, সে ব্যাপারে অন্যকে কীভাবে কনভিন্স করব বলুন তো? আর তা ছাড়া বাংলাদেশে মধ্যবর্তী নির্বাচন হলে আমাদের তো কোনও লাভ নেই! বরং শেখ হাসিনা দেশের ভেতরের পরিস্থিতিও অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছেন, এখন নির্ধারিত সময়ে ভোট হলে তো কোনও ক্ষতি নেই!’
তবে কূটনৈতিক চ্যানেলের বাইরেও রাজনৈতিক স্তরেও ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার কিন্তু বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, উভয়পক্ষের সঙ্গেই যোগাযোগ রেখে চলে। বাংলা ট্রিবিউনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের সঙ্গে এই যোগাযোগটা রাখেন বিজেপির দুজন নেতা, রাম মাধব ও এম জে আকবর। রাম মাধব আরএসএসের তাত্ত্বিক নেতা, এখন বিজেপির খুব প্রভাবশালী সাধারণ সম্পাদক। অন্য দিকে এম জে আকবর সম্প্রতি ঝাড়খন্ড থেকে বিজেপি-র এমপি হয়ে এসেছেন, বিখ্যাত এই সাংবাদিক দলের জাতীয় মুখপাত্রেরও দায়িত্ব।
নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক ঢাকা সফরের আগেও তার গ্রাউন্ডওয়ার্ক তৈরি করতে দিনকয়েক আগেই ঢাকা পৌঁছে গিয়েছিলেন আকবর। দিল্লি থেকে ঢাকা তিনি নিয়মিতই যাতায়াত করে থাকেন। এমনই কোনও সফরে তিনি সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম-সহ আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। যতদূর জানা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে কী চাইছে সেই বার্তাটা এমন কোনও বৈঠকেই পৌঁছে দেওয়া হয়েছে – যদিও এটা যে ভারতের বক্তব্য নয় স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে সেটাও। অর্থাৎ ট্র্যাক-টু চ্যানেলে ভারত বাংলাদেশেকে যুক্তরাষ্ট্রর পছন্দ-অপছন্দর ব্যাপারটা জানাচ্ছে ঠিকই – কিন্তু নিজেদেরকে সেটা থেকে সচেতনভাবেই অনেক দূরে রেখেছে।
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান জানতে বাংলা ট্রিবিউনের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে। দূতাবাস জানিয়েছে, ‘আমরা একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় সমর্থন দিয়ে যাব। তথাপি, ভবিষ্যতের নির্বাচনের দিনক্ষণ বাংলাদেশের জনগণই ঠিক করবে। দেশটির দলগুলোকে একটি রাজনৈতিক অঙ্গনে থেকে কার্যক্রম চালানোর অনুরোধ জানাবো আমরা।’
ভারতকে চাপ দেওয়ার প্রসঙ্গ এড়িয়ে দূতাবাস আরও জানায়, ‘যুক্তরাষ্ট্র সবসময় ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে একটি শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক লক্ষ্য অর্জনে গণতন্ত্র, শাসন, বাণিজ্য ও নিরাপত্তায় পারষ্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতেই কাজ করে যাবে যুক্তরাষ্ট্র।’

Share this

0 Comment to "মধ্যবর্তী নির্বাচনে ‘বিদেশি চাপ’ থাকলেও মেয়াদ শেষ করাই সরকারের টার্গেট"

Post a Comment